অটিজম বৈশিষ্ট্যের শিশুর বয়ঃসন্ধিকালের সমস্যাগুলো কীভাবে সামলাবেন

আর দশটা শিশুর মতো সময়ের পরিক্রমায় অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুরাও একসময় কৈশোরে পা রাখে। বয়ঃসন্ধিকাল অর্থাৎ ১০ থেকে ১৯ বছর বয়স তাদেরও অতিক্রম করতে হয়। অন্যান্য শিশুর মতো তাদের দেহে-মনেও বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তনগুলো আসতে থাকে। তাদের প্রজননতন্ত্রসমূহ পরিবর্তন হতে থাকে, গলার স্বর বদলাতে থাকে, মেয়েদের পিরিয়ড শুরু হয়। আর দশটা কিশোর-কিশোরীও কিন্তু এই পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নিতে গিয়ে কিছু কিছু সমস্যার মুখে পড়ে। আর অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের দেহ-মনের এই পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নিতে আরেকটু বেশি বেগ পেতে হয়, তাদের নানা রকম আচরণের সমস্যা দেখা দেয়; কখনো তাদের শারীরিক নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়ে।

অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের বয়ঃসন্ধিকাল শুরুর আগে থেকে বিষয়টি নিয়ে মা-বাবা, শিক্ষক এবং যত্নকারীকে সচেতন হতে হবে। এ জন্য যেসব বিষয়ের দিকে নজর দিতে হবে—

পূর্বপ্রস্তুতি: অটিজম রয়েছে, এমন একটি ছেলে বা মেয়েসন্তানকে তার বয়ঃসন্ধিকাল আসার আগে থেকেই (১০ বছর বয়সের আগেই) নানা মাধ্যমে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে, যে তার দেহ আর মনের কিছু পরিবর্তন আসবে। কাউকে গল্পের মাধ্যমে, কাউকে ছবি ব্যবহার করে শারীরিক পরিবর্তনগুলো বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে। নারী-পুরুষের দৈহিক পার্থক্যগুলো তার সক্ষমতা অনুযায়ী বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে।

আরো পড়ুন:অসহায় প্রতিবন্ধী শিশুর স্কুল রক্ষার দাবিতে কেরানীগঞ্জ অটিস্টিক বিদ্যালয় অভিভাবকরা মানববন্ধন ও অনশন করেন শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে। 

নিরাপত্তা: তাদের শারীরিক আর মানসিক নিরাপত্তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। শরীরের স্পর্শকাতর অঙ্গগুলোর নাম শেখাতে হবে। সেগুলো অন্যরা যাতে স্পর্শ করতে না পারে, সে জন্য ‘মন্দ স্পর্শ’, ‘ভালো স্পর্শ’ বিষয়গুলো রোল প্লে করে বা ছবির মাধ্যমে বারবার অনুশীলন করে বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে। সে নিজেও যেন অন্য কারও শরীর অযাচিতভাবে স্পর্শ না করে, এটাও তাকে বোঝাতে হবে।

বিশেষ পরিচ্ছন্নতা: দৈনন্দিন সাধারণ পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি বয়ঃসন্ধিকালে তাকে আরও কিছু বিশেষ পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। বিশেষ করে পিরিয়ডের দিনগুলোতে মেয়েশিশুকে নিজের যত্ন আর পরিচ্ছন্ন থাকার কৌশল শেখানোর চেষ্টা করতে হবে। অন্তর্বাস পরিচ্ছন্ন রাখার অভ্যাস ছেলে–মেয়ে উভয়কেই শেখাতে হবে। মা-বাবা নিরাপদ মনে করলে তদারকি করে তাদের দাড়িগোঁফসহ শরীরের নানা স্থানের চুল কাটার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

ভাষা ব্যবহারে সচেতনতা: অটিজম বৈশিষ্ট্য রয়েছে এমন শিশুর সামনে সংবেদনশীল শব্দ বিশেষ করে যৌনতা–সংশ্লিষ্ট শব্দ ব্যবহারে সতর্ক থাকতে হবে।

উপযুক্ত যৌনশিক্ষা: তার সক্ষমতা আর বুদ্ধিমত্তা অনুযায়ী বয়ঃসন্ধিকাল থেকেই তাকে কিছুটা যৌনজ্ঞান প্রদান করতে হবে। ঋতুচক্র, হস্তমৈথুন বিষয়ে তাকে সঠিক এবং বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান প্রদান করতে হবে। এগুলো তাকে একদিকে নিরাপত্তা দেবে, আরেক দিকে বিব্রতকর আচরণ করা থেকে দূরে রাখবে।

আগ্রাসী আচরণ নিয়ন্ত্রণ: অটিজম রয়েছে এমন শিশুরা বয়ঃসন্ধিকালে অনেক সময় আগ্রাসী আচরণ করে। এ সমস্যায় প্রথমত কেন এমনটা করছে, সেটা খুঁজে বের করতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিয়ে ওষুধ দেওয়া যেতে পারে।

মনে রাখতে হবে, অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন প্রতিটি শিশুই ভিন্ন। তাই একই পদ্ধতি সবার জন্য সমান প্রযোজ্য না–ও হতে পারে। বয়ঃসন্ধিকালে তার পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে সে নিজেকে কীভাবে মানিয়ে নিচ্ছে, তার সক্ষমতা আর দুর্বলতাগুলো কী কী, তার বুদ্ধির মাত্রা কী রকম, সেগুলো বিবেচনা করে মা-বাবা এই বয়সে শিশু–কিশোরদের বিশেষ যত্ন নেবেন। একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে মা-বাবা বা শিক্ষক বিষয়গুলো তাকে জানানোর আগে যেন সে অন্য কোনো মাধ্যম বিশেষ করে ইন্টারনেট বা টিভি থেকে কোনো অবৈজ্ঞানিক ভুল তথ্য বিকৃত বা খণ্ডিতভাবে না পায়। তাই মা-বাবা বা শিক্ষকেরা আগে থেকেই উদ্যোগী হয়ে পরিকল্পনামাফিক এগোবেন।

উৎস: ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ(সহযোগী অধ্যাপক, শিশু–কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা), প্রথম আলো।