স্বাস্থ্য শিক্ষা কি বা কাকে বলে? স্বাস্থ্য শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং নীতি

ভূমিকা :-

স্বাস্থ্যই ‘অমূল্য সম্পদ’, এই চিরসত্যটি আমরা সবাই জানি। আর প্রকৃত শিক্ষাগ্রহণের মাধ্যমেই ব্যক্তি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে পারে ও তার মধ্যে স্বাস্থ্য সম্পর্কে ধারণা আসে। স্বাস্থ্য হলো ব্যক্তির সার্বিক অবস্থা যা তাকে যে-কোনো পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি সমাজের ভালোমন্দ বুঝাতে সাহায্য করে।

স্বাস্থ্য শুধুমাত্র রোগ থেকে মুক্তি বা অসুস্থতার অভাব বা শারীরিক সুস্থতা নয়, স্বাস্থ্য হলো ব্যক্তির সামাজিক, মানসিক ও শারীরিক গুণাবলির এমন একটি সমন্বয় যা তাকে পরিপূর্ণ জীবনযাপনে সহায়তা করে।

স্বাস্থ্য এমন একটি বিষয় যা মানুষকে আত্মপ্রতিষ্ঠালাভের পথ দেখায় ও ব্যক্তিত্ব গঠনে সাহায্য করে। ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ যন্ত্র ও তন্ত্রগুলিকে স্বাভাবিক ও সুস্থ রেখে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে, তার জীবনীশক্তি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।

ব্যক্তির স্বাস্থ্যই হলো প্রকৃত সম্পদ। ব্যক্তির স্বাস্থ্য ব্যক্তিগত, পরিবেশগত ও সামাজিক অনেকগুলি নিয়ামক দ্বারা পরিচালিত এবং নির্ধারিত হয়।

স্বাস্থ্য শিক্ষা কি বা কাকে বলে :-

যে শিক্ষা মানুষের স্বাস্থ্য বিষয়ক আচরনের পরিবর্তন ঘটায় তাঁকে বলে স্বাস্থ্য শিক্ষা। সহজ ভাষায় বলা যায়, স্বাস্থ্য শিক্ষা হল, মানুষকে স্বাস্থ্য ও ব্যাধির বিষয়ে জ্ঞান প্রদান করা, মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটানো এবং কষ্ট বা অসুস্থতা জয়ী করে সুন্দর স্বাস্থ্যর দিকে এগিয়ে যাওয়ার যথাযথ পদ্ধতি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা 1954 সালে একটি প্রতিবেদনে বলেছেন –

প্রচলিত শিক্ষার মতো স্বাস্থ্য শিক্ষাও আমাদের জ্ঞান, অনুভূতি ও আচরণের বদলের সাথে সম্পর্ক যুক্ত।সর্বচ্চো প্রচলিত ধারা অনুযায়ী এটি আমাদের এমন কিছু স্বাস্থ্য অভ্যাসের বদল ঘটায় যারা মানুষের সর্বত্রভাবে মঙ্গল সূচিত হয় ।

Sophic স্বাস্থ্য শিক্ষা কি এ সম্পর্কে বলেছেন 

মানুষের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত আচরণকেই বলা হয় স্বাস্থ্য শিক্ষা।

Thomas wood স্বাস্থ্য শিক্ষা কাকে বলে সে সম্পর্কে বলেছেন –

স্বাস্থ্য শিক্ষা হল স্কুল এবং অন্যান্য প্রাপ্ত অভিজ্ঞতার সমষ্টি যা প্রতিকূল ভাবে ব্যাক্তি, সমাজ ও সামাজিক স্বাস্থ্য বিষয়ে অনুশীলন, মনোভাব ও জ্ঞানকে পধরিব্যাপ্ত করে।

স্বাস্থ্য শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য :-

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বা WHO-র স্বাস্থ্য শিক্ষার বিষয়ক কমিটির মতে – স্বাস্থ্য শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করা তার মাধ্যমে দীর্ঘদিন বেঁচে থেকে পরিবার, সমাজ তথা দেশের সেবা করা। স্বাস্থ্য শিক্ষার সাধারণত তিনটি মূল উদ্দেশ্য লক্ষ্য করা যায় । তথা –

১. মানুষকে তথ্য জ্ঞাপন করা।

২. মানুষকে প্রেরণা দান করা।

৩. কাজ করার জন্য পথপ্রদর্শন করা।

অনেকেই এই উদ্দেশ্য গুলিকে আবার অন্য ভাবে ব্যক্ত করেছেন, যেমন –

A. স্বাস্থ্য সম্পর্কিত জ্ঞানের বিকাশ ।

B. অনুমোদনযোগ্য স্বাস্থ্যগত মনোভাবের বিকাশ।

C. অনুমোদনযোগ্য স্বাস্থ্য অভ্যাসের বিকাশ।

১. মানুষকে তথ্য জানানো বা স্বাস্থ্য বিষয়ক জ্ঞানের প্রকাশ :-

স্বাস্থ্য শিক্ষার প্রথম উদ্দেশ্য হল মানুষকে তথ্য জ্ঞাপন করা বা গবেষণা ও আবিষ্কারের মাধ্যমে প্রাপ্ত ব্যবস্থা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তথ্য গুলিকে মানুষের সামনে উপস্থাপন ও ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে মানুষকে জ্ঞানের বিকাশ ঘটানো। এই তথ্যগুলো পাওয়ার মাধ্যমে ব্যক্তিবর্গ তাদের স্বাস্থ্য বিষয়ক সমস্যাগুলি চিহ্নিত করে তার তথ্যগুলি যথাযথ নিরাময়ের ব্যবস্থা করতে পারে। এগুলি স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য বিজ্ঞান বিষয়ক অজ্ঞানতা, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস এবং ভ্রান্ত ধারনাকে দূর করতে সাহায্য করে।

আরও পড়ুন :-একঝাঁক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হূদরোগ বক্ষব্যাধি মেডিসিন শিশু বিশেষজ্ঞ হেপাটলজি আপনার পছন্দমত ডাক্তারটি আপনি বেছে নিন

২. মানুষকে প্রেরণা দান করা বা অনুমোদনযোগ্য স্বাস্থ্যগত মনোভাবের বিকাশ :-

স্বাস্থ্য সম্পর্কে মানুষকে তথ্য প্রদান করাই যথেষ্ট নয়। তাদের এমনভাবে প্রেরনা দান করতে হবে যাতে তারা দৈনন্দিন জীবনে এই জ্ঞান ব্যবহার করতে পারে এবং এর মাধ্যমে তাদের আচরণগত, মনভাবগত, অভ্যাসগত পরিবর্তনের পাশাপাশি জীবনশৈলীর পরিবর্তন সংঘটিত হয়। ব্যক্তি যখন এই স্বাস্থ্যময় মনোভাব অর্জন করে তখন তার মাধ্যমে এই মনোভাব জ্ঞান পরিবার, গোষ্ঠী, সমাজ তথা দেশে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।

৩. কাজ করার জন্য পথপ্রদর্শন করা বা অনুমোদনযোগ্য স্বাস্থ্য অভ্যাসের বিকাশ :-

যতক্ষন না মানুষ স্বাস্থ্যগত সুপ্রভাস অর্জন করে এবং তারা স্বাস্থ্যপূর্ণ জীবনশৈলী গ্ৰহন করে ও মেনে চলে, ততক্ষন জ্ঞান অর্জন অর্থহীন বা নিখিল হয়ে থাকে। স্বাস্থ্যগত অভ্যাস মানুষের স্বাস্থ্যগত অবস্থাকে নির্দেশ করে। ক্ষতিকর অভ্যাসের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিলে দূর্বল ও ঘাটতিপূর্ণ স্বাস্থ্যের প্রকাশ ঘটে, অপরদিকে সু-অভ্যাসগুলি সু-উত্তম ও ধনাত্মক স্বাস্থ্য নির্দেশ করে। স্বাস্থ্য শিক্ষার নীতিগুলি প্রতিনিয়ত নানাভাবে আমাদের পথ প্রদর্শন করে এবং এর ফলেই অনুমোদনযোগ্য অভ্যাসের বিকাশ ঘটে।

স্বাস্থ্য শিক্ষার নীতি (Principles of Health Education) :-

১. আগ্রহের নীতি :-

একটি সর্বজনীন স্বীকৃত সত্য হল এই যে মানুষের যে বিষয়ের প্রতি আগ্রহ থাকে মানুষ সেই কথাই শুনতে চায়। তাই স্বাস্থ্য বিষয়ক শিক্ষাদান ও স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মসূচির পদ্ধতি সমূহ এমন রূপে গঠন করা উচিত যেন এগুলোর মাধ্যমে মানুষের আগ্রহের বৃদ্ধি পায়।

২. প্রকৃত স্বাস্থ্য চাহিদার নীতি :-

মানুষের প্রকৃত চাহিদা সম্পর্কে না জেনে কোনো স্বাস্থ্য কর্মসূচি রূপায়ণ করা উচিত নয়। মানুষের প্রকৃত স্বাস্থ্য চাহিদা অনুসারে কর্মসূচি রূপায়ান করলে তাতে মানুষ সানন্দে অংশগ্রহন করে। অর্থাৎ কর্মসূচি সর্বদা চাহিদা ভিত্তিক হওয়া চাই।

৩. বাস্তবতার নীতি :-

স্বাস্থ্য শিক্ষা কখনই কৃত্রিম ভাবে দেওয়া যায় না, এটি সর্বদাই বাস্তবসম্মত হওয়া দরকার। রীতিবদ্ধ শিক্ষণ-শিখণ পদ্ধতির মাধ্যমে স্বাস্থ্যশিক্ষা দেওয়া যায় না।

4. জানা থেকে অজানার নীতি :-

স্বাস্থ্য শিক্ষার কর্মসূচি সর্বদা জানা থেকে অজানার উদ্দেশ্য হওয়া দরকার। এটি শুরু হওয়া উচিত জনগণের জানা অভ্যাস বা মনোভাবে মধ্য দিয়ে এবং ধীরে ধীরে তাদের বিভিন্ন অজানা আচরণে অভ্যস্ত করা দরকার।

৫. সমাজের মধ্যে উপস্থিত সংস্কৃতি উপলদ্ধির নীতি :-

স্বাস্থ্য শিক্ষা দিতে গেলে প্রথমেই সমাজের সংস্কৃতি অনুধাবন করা দরকার এবং তারপর সেই সংস্কৃতি অনুসরন করে মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য শিক্ষার মহান আদর্শ ছড়িয়ে দেওয়া দরকার।

৬. সক্রিয় অংশগ্রহনের নীতি :-

স্বাস্থ্য শিক্ষার শিক্ষণ-শিখন কর্মসূচি রূপায়ানের অন্যতম প্রধান হল সক্রিয় অংশগ্রহন। দলগত আলোচনা, কর্মশালা, পথসভা প্রভৃতি সংগঠনের মাধ্যমে মানুষকে স্বাস্থ্যের ও ঋণাত্মক দিকগুলি সম্পর্কে সহজেই জ্ঞাত করা যায়। মানুষ এই কর্মসূচি গুলিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করতে পারে।

৭. সহজ – সরল প্রবর্তনের নীতি :-

স্বাস্থ্য শিক্ষাকে ব্যক্তির জ্ঞান-বোধ, শিক্ষাগত যোগ্যতা, মানসিক ক্ষমতা ও অক্ষরজ্ঞানের মাত্রা অনুসারে প্রবর্তন বা উপস্থাপন করা দরকার। এর ভাষা হবে সহজ-সরল যাতে সকল শ্রেণির মানুষ এটির সঙ্গে একাত্ম হতে পারে।

আরও পড়ুন :- ১১ দফা দাবিতে রাস্তায় প্রতিবন্ধী স্কুলের শিক্ষকরা

৮. মুক্ত আদান-প্রদানের নীতি :-

স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মসূচির সাফলা উন্মুক্ত জনসংযোগ বা ভাবের আদান-প্রদানের ওপর নির্ভর করে। স্বাস্থ্য শিক্ষায় শিক্ষককে শিক্ষাদান করে চুপ-চাপ বসে থাকলে হবে না, তিনি সর্বদা তাদের মতামত গ্রহন করে দুর্বলতা ও প্রশ্নের নিরশন করতে সচেষ্ট হন।

৯. কাজের মাধ্যমে শিক্ষার নীতি :-

স্বাস্থ্যশিক্ষার কর্মসূচি কর্মের মাধ্যমে শিক্ষন নীতির ওপর নির্ভরশীল হওয়া দরকার। এই শিক্ষা হবে ব্যবহারিক । ধনাত্মক প্রকৃতির যাতে ব্যক্তি অংশগ্রহনের মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করে।

১০. দল বা গোষ্ঠীর নীতি :-

স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মসূচি গুলিতে ব্যক্তিকে এককভাবে অংশগ্রহন না করিয়ে তার পরিবার, গোষ্ঠী, গ্রাম প্রভৃতি বৃহত্তর অংশকে দলবদ্ধ আকারে অংশ গ্রহন করতে পারলে সর্বাধিক ফলাফল লাভ করা যায়।

৯ মূল্যায়নের নীতি :-

স্বাস্থ্য শিক্ষাও মূল্যায়নের বাইরে নয়। প্রতিনিয়ত এই শিক্ষার উপযোগিতা ও কার্যকারিতার বিষয়ে মূল্যয়ন করা দরকার। নিয়মিত ও ধারাবাহিক মূল্যায়নের এর পরিবর্তন বাঞ্ছনিয়।